ভালোবাসার রসায়ন

ভালোবাসার রসায়ন


ভালোবাসা আসলে কোনো আবেগ নয় বরং ক্ষুধা তৃষ্ণার মতো এক ধরনের প্রবৃত্তি বা তাড়না। রাসায়নিক আধিক্যের কারণে মানুষ শারীরিক নৈকট্যের চাহিদা অনুভব করে। ভালোবাসার

এই রসায়ন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার চুম্বকাংশ নিয়ে প্রতিবেদনটি

তৈরি করেছেন_ শামছুল হক রাসেল ও খুরশীদা রহমান চৈতী



নন-রোমান্টিক বিজ্ঞানীদের কাছে ভালোবাসার অনুভব, উত্তেজনা, দেহ-মনের বিস্ময়কর নতুন আলোড়ন শুধুই কিছু রাসায়নিক পদার্থের বিক্রিয়া মাত্র। এ বিক্রিয়া শুরু হয় বুকের বাঁ পাশের হৃৎপিণ্ড থেকে। তা মূলত মস্তিষ্ক-জাত! নিউজার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার মতে 'ভালোবাসা আসলে কোনো আবেগ নয়। বরং ক্ষুধা-তৃষ্ণার মতো এক ধরনের প্রবৃত্তি বা তাড়না।' এ বিষয়ে দেশের প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, ভালোবাসার বিষয়টি অনেক বিশাল ব্যাপার। কাউকে প্রথম দর্শনে ভালো লেগে যেতে পারে। আবার কাউকে দীর্ঘ পরিচয় সূত্রে ভালো লাগতে পারে। মানুষ যখন কারও প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, তখন তার মস্তিষ্ক ক্রমাগত ডোপামিন, নরএপিনেফ্রিন, ফিনাইলইথাইলঅ্যামাইন (পিইএ) ইত্যাদির উৎপত্তি ঘটে। ভালোবাসার মোহগ্রস্ততার জন্য দায়ী করা হয় মূলত এই তিনটি রাসায়নকে। নরএপিনেফ্রিন, যার অপর নাম নরঅ্যাড্রিনালিন। যা থেকে তৈরি হয় অ্যাড্রিনালিন_ যার অধিক উপস্থিতির কারণে হৃৎপিণ্ডের কাজের গতি বাড়ে, হাত-পা ঘেমে যায়। নরএপিনেফ্রিনের উচ্চমাত্রা সুখের অনুভূতিও বাড়ায়, অন্যদিকে খাওয়ার রুচি কমে যায়। এ বিষয়ে আরও জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ডোপামিনের উপস্থিতি আনন্দের অনুভূতি জাগায়। এছাড়া ডোপামিন মানুষকে উত্তেজিত ও 'বাচাল' করে তোলে। যার ফলে রাত জেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রেমিক-প্রেমিকারা কথা বলেন। নিজের কষ্টার্জিত পয়সা কথার মাধ্যমে খরচ করে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সমৃদ্ধ করে। এই ডোপামিন থেকেই তৈরি হয় নরএপিনেফ্রিন। ফিনাইলইথাইলঅ্যামাইন বা পিইএ নরএপিনেফ্রিন এবং ডোপামিন উভয়েরই নিঃসরণে সহায়তা করে। রোমান্টিক ভালোবাসার সেই ঝিম ঝিম করা, অপার্থিব জগতে ভেসে বেড়ানোর সুখানুভূতি পিইএ-এর অবদান। অনেক দিন আগে জনৈক বিজ্ঞানী রসিকতা করে বলেছিলেন, কিউপিডের তীরের কোনো কার্যকরিতা নেই, যদি না তীরের মাথায় কিছুটা পিইএ মাখানো থাকে। ভালোবাসার মানুষটির স্পর্শ, একটুখানি চোখের দেখা বা একটুখানি হাতের ছোঁয়া এমনকি প্রেয়সীর ভাবনায় তার উপস্থিতিই নিঃসরণ ঘটাতে পারে এসব রাসায়নিক। ভালোবাসার তোড়ে ভুলে যাচ্ছে সামাজিক বিধি-নিষেধ, পারিবারিক বন্ধন, নৈতিকতা_সবকিছু। এমনকি ভালোবাসার মোহে সঙ্গীর সঙ্গে পাড়ি দেয় অজানার উদ্দেশ্যে। পেছনে পড়ে থাকে পরিবারের মায়া। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের বাড়ন্ত সময়ের, শৈশব-কৈশোরের অপ্রাপ্তি-অপূর্ণতা এবং আমাদের অবচেতনার উপস্থিতিই এসব রাসায়নিকের নিঃসরণ বাড়ায়, আমরা তাকেই 'ভালোবাসা' বলে অনুভব করি। তার কাছে জগতের সব সৃষ্টি তুচ্ছ বলে মনে হয়। ভালোবাসার এ প্রাপ্তি হতে পারে নিরাপত্তা, শ্রদ্ধা, আদর। অপর দিকে এর উল্টোটাও ঘটতে পারে অর্থাৎ অনিরাপত্তা, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি। সম্প্রতি তরুণ-তরুণীদের নিয়ে গবেষণাকৃত একটি ফলাফলে দেখা গেছে, অবচেতনের অ্যাডভেঞ্চারের অতৃপ্ত আকাক্সক্ষাই তাদেরকে এ পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। অনেক সময় রক্ষণশীল, ভদ্র পরিবেশে বেড়ে উঠা এসব মেয়েদেরকে উড়নচণ্ডী, 'রাফ এন্ড টাফ' ছেলেদের প্রেমে পড়তে প্রলুব্ধ করে। এর একটাই কারণ সেটি হলো ভালোবাসার রসায়নকে অতিসহজে আয়ত্ব করার চেষ্টা। ভালোবাসার এই তীব্রতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যৌনতা। বিজ্ঞানীরা বলেন, যৌন আাকাক্সক্ষা বা মিলনের পেছনেও রয়েছে রাসায়নিকের হরেকরকম খেলা। টেস্টোস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, ডোপামিন বেড়ে যায় কামজ উদ্দীপনার সময়। সে সঙ্গে বাড়ে কাম লালসা। এ ছাড়াও এ কামনার পেছনে ভূমিকা রয়েছে প্রোল্যাক্টিন, অক্সিটোসিনেরও। অক্সিটোসিনকে বলা হয় সংলগ্নতার হরমোন। এই রাসায়নিকের আধিক্যের কারণে আমরা শারীরিক নৈকট্যের তাগিদ অনুভব করি। অবশ্য, এসব রাসায়নিকের তৎপরতা চিরস্থায়ী নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যকারিতাও হারায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হরমোনজনিত কারছে ভাটা পড়ে ভালোবাসার তীব্রতায়। পাশাপাশি দূরত্ব বাড়ে দম্পত্যের মমতায়। ব্যক্তিভেদে এসব রাসায়নিকের ক্রিয়াকালও ভিন্ন হয়। কেউ বলেন, ছয় মাস থেকে তিন বছর, আবার কেউ বলেন দেড় থেকে চার বছর থাকে এর কার্যকারিতা। এরপর ভালোবাসা মরে যায়! অনেকেই বলে জানালা দিয়ে ভালোবাসা পালিয়ে যায়। 'সেক্সি অরিজিন এন্ড ইনটিমেট থিংস' বইয়ে লেখক চার্লস পানাটি বলেছেন, বিয়ের চতুর্থ বছরের মাথায় বিচ্ছেদের হার সর্বোচ্চ। এই নির্দিষ্ট সময়ের পর অন্য কারও উপস্থিতি অর্থাৎ পরকীয়ায় জড়াতে পারেন। হয়তো এ পরকীয়া সম্পর্ক নতুন করে উজ্জীবিত করতে সহায়তা করে মানুষের এই রাসায়নিক নিঃসরণের মাত্রা। বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ড. রকিবুল ইসলাম লিটুর মতে ভালোবাসার মানুষকে কাছে না পেলে অনেক সময় উল্টাটাও ঘটতে পারে। এ সময় শরীরে অ্যাড্রিনালিন নামক হরমোন বেড়ে যায়। ফলে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে। শরীরে রক্তচাপ ও ধমনীর চাপ বেড়ে যায়। ফলে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, এ রাসায়নিক থিওরি অনুযায়ী, মানুষ একগামী নয়। প্রাণীজগতের যে ৩ ভাগ প্রজাতি একগামী, সামগ্রিকভাবে মনুষ্যপ্রজাতি তার মাঝে পড়ে না। একগামী প্রজাতির মস্তিষ্কে 'ভেসোপ্রেসিন' নামের আরেক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি থাকে প্রচুর পরিমাণে। এই ভেসোপ্রেসিনকে বলা হয় একগামিতার রাসায়ন। এ ছাড়াও অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ও ভেসোপ্রেসিন হরমোনের আধিক্যও সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।