শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা


অসুখ হলে ওষুধ খেতে হয়_ এ কথা আমরা সবাই জানিকিন্তু সঠিক নিয়মে ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করি নাওষুধ খেতে আমরা যতটা তৎপর, ওষুধ খাওয়ার নিয়ম মানতে ততটাই উদাসীনআমাদের এই অবহেলা জীবনরক্ষাকারী ওষুধকে করে তুলতে পারে জীবনবিনাশী বিষ

ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই যে অনিয়মটা করি তা হলো চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়াআমরা নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করি, কখনও আত্মীয়, কখনও বন্ধুর পরামর্শ নেই, কখনও ডাক্তারের চেয়ে ওষুধ বিক্রেতার ওপর বেশি নির্ভর করি'অমুক ওষুধে তমুক ভালো হয়েছিল, তাই আমিও ভালো হব'_ এমন চিন্তাই আমাদের মধ্যে কাজ করেঅথচ লক্ষণ এক হলেই অসুখ এক হবে এমন কোনো কথা নেইআবার একই রোগে একই ওষুধের মাত্রা রোগীভেদে ভিন্ন হতে পারেশুধু অসুখে নয়, ওষুধ সহজলভ্য হওয়ায় সুখেও আমরা অন্যের পরামর্শে ওষুধ খাইমোটা হওয়ার জন্য স্টেরয়েড বা শক্তি বাড়ানোর জন্য ভিটামিন খাই ভাতের চেয়ে বেশিএসবের মারাত্মক, কখনও জীবনবিনাশী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ

যদিও বা কখনো (বাধ্য হয়ে) ডাক্তারের পরামর্শ নেই, ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডাক্তারের বেঁধে দেওয়া বিধি-নিষেধ মানি কমসময়মতো ওষুধ খাওয়া, খাওয়ার আগে না পরে তা বুঝে খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা_ এসব আমরা খেয়াল রাখি নাবিশেষ করে এন্টিবায়োটিকের ডোজের ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি উদাসীন থাকিসবচেয়ে ভয়াবহ হলো ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া'জ্বর ভালো হয়ে গেছে, এন্টিবায়োটিক আর কি দরকার'_ ভেবে নিজেরাই ওষুধ বন্ধ করে দেইআবার অন্যদিকে কয়েকদিনে জ্বর ভালো না হলে 'ওষুধ ঠিক নেই' ভেবে তা বন্ধ করে দেই এবং অন্য ডাক্তারের কাছে নতুন ওষুধের প্রত্যাশায় যাই যেসব অসুখে দীর্ঘদিন বা আজীবন ওষুধ খেতে হয় সেখানে আমরা অসুখ নিয়ন্ত্রণে আসলেই তা বন্ধ করে দেই, বুঝতে চাই না যে, রোগ ভালো হয়নি, নিয়ন্ত্রণে আছে কেবলএকসময় লোকমুখে 'ক্যান্সারের ওষুধ' শুনে বাতের ওষুধ বন্ধ করার ঘটনা প্রচুর হয়েছেওষুধ শুরুর মতো বন্ধ করার সময়ও আমরা নিয়ম মানি নাযেসব ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করা যায় না তা নিজেরাই হঠাৎ বন্ধ করে দেইওষুধ নিয়ে এই অনাচারে কি ক্ষতি হতে পারে? প্রথম কথা যে রোগের জন্য ওষুধ সেবন করা তার উপশম হবে না, বরং খারাপ হতে পারেওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর আবির্ভাব এক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক হুমকিএন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার জীবাণুর বিরুদ্ধে এদের অকার্যকর করে দিচ্ছেসঠিক এন্টিবায়োটিক দিয়ে যে রোগ শুরুতেই ভালো করা যেত, অপব্যবহারের কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না, নতুন দামী ওষুধ দরকার হচ্ছে, কখনও তাতেও কাজ হচ্ছে নাবিশেষভাবে বলা যায় যক্ষ্মার কথাযেখানে কমপক্ষে ৬ মাস ওষুধ খেতে হয়, অথচ অনেকেই কয়েক মাস খেয়ে 'ভালো হয়ে গেছি' মনে করে তা বন্ধ করে দেয়ফলশ্রুতিতে তা মারাত্মক মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবিতে পরিণত হয় যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিনআর্থিক দিকটাও বিবেচনা করা জরুরি যে চিকিৎসা এখন সুলভে হচ্ছে, অবিবেচকের মতো ওষুধ খেলে তা পরবর্তীতে ব্যয়বহুল হয়ে যেতে পারে

শুধু জীবাণু সংক্রমণ নয়, হাই ব্লাডপ্রেসার, ডায়বেটিস ইত্যাদি অসুখেও 'মাঝে মাঝে ওষুধের ব্যবহার' উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে

নিয়মিত ওষুধ খেলেও যদি সেবনবিধি না মানা হয় তবে অনেক ওষুধই অকার্যকর হয়ে যায় খালি পেটে খাবার ওষুধ ভরা পেটে খেলে তা না খাবার মতোই হবেএছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এক ওষুধ অন্য ওষুধের উপস্থিতিতে কাজ করে নাঅজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শে এসব ওষুধ একত্রে খেলে লাভ তো হবেই না, বরং ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে

মনের মতো ওষুধ খাওয়ার আরেক সমস্যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াএকজন চিকিৎসক ভালো মতোই জানেন কোন ওষুধের কি সমস্যা আর তাই তা কাকে দেয়া যাবে, কাকে যাবে নানিজে থেকে ওষুধ খেলে এসব বিবেচনা সম্ভব নয়, তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বেশিব্যথার ওষুধ খেয়ে পেট ফুটো হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটেমোটা হওয়ার জন্য স্টেরয়েড খেয়ে অনেকেই মারাত্মক কুশিং সিনড্রোমে আক্রান্ত হন, যা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করেও অনেকে বিপদে পড়েন, বিশেষ করে স্টেরয়েড হঠাৎ বন্ধ করলে এডিসনিয়ান ক্রাইসিস হতে পারে যাতে থেকে রোগী মারাও যেতে পারে

সাধারণ ওষুধ, যার অনেকগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই পাওয়া যায়, বিশেষ অবস্থায় তাও হতে পারে ক্ষতিকরআমরা অনেকেই জানি না যে, ভিটামিন এ বা ক্রিমির ওষুধের মতো সাধারণ ওষুধ গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করেলিভারের রোগীর জন্য প্যারাসিটামলের মতো ওষুধ হতে পারে ক্ষতির কারণ

অবস্থার জন্য দায়ী আমরা সবাইরোগী যেমন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া বাহুল্য ভাবছেন, ডাক্তার তেমনি রোগীকে সঠিক পরামর্শ দিচ্ছেন না, আর কর্তৃপক্ষ হয়ে আছেন উদাসীন

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রোগীদের যা মেনে চলা উচিত তা হলো_

১. শুধু ডাক্তার পরামর্শ দিলেই ওষুধ সেবন করা যাবে২. বিশেষ অবস্থায় (যেমন গর্ভাবস্থা, লিভারের রোগ ইত্যাদি) সাধারণ ওষুধ যা প্রেসক্রিপশন ছাড়া পাওয়া যায়, তাও ডাক্তারের পরামর্শেই ব্যবহার করতে হবে৩. শুধু ফার্মাসিস্টের কাছ থেকে ওষুধ কেনা উচিতকেনার সময় তার মেয়াদকাল দেখে নিতে হবেমনে রাখবেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আপনার রোগ সারানোর পরিবর্তে ক্ষতি করতে পারে৪. ডাক্তার ওষুধ খাবার যে নিয়ম বলে দেবেন (কতটুকু ওষুধ, কতক্ষণ পরপর, কত দিন, খাবার আগে না পরে ইত্যাদি), সে অনুযায়ী তা সেবন করতে হবেপ্রয়োজনে তা লিখে রাখুন বা মনে রাখতে অন্যের সাহায্য নিননিজে থেকে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করা যাবে না৫. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত নিজে ওষুধ কিনে সেবন করবেন না এতে আপনি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেনঅনেকে নিজে নিজেই দুর্বলতার জন্য ভিটামিন জাতীয় ওষুধ খেতে থাকেনএক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ভিটামিন শরীরের দুর্বলতা দূর করে নাযে কারণে শরীর দুর্বল হয় সে কারণ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে হবেঅপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত ভিটামিন খেলে তারও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে৬. অনেকে একবার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বার বার সেই ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনেনএক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, প্রথম ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধ যতদিন খেতে বলা হয়েছে ততদিনই খাওয়া যাবেপুনরায় একই অসুখ হলেও সেই একই ওষুধ কাজ নাও করতে পারে৭. অনেকে সামান্য কারণেই ব্যথার ওষুধ বা এন্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করেনঅনেকে এমন কি স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও খানডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই এভাবে ওষুধ খেলে উপকার তো হবেই না, বরং স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে৮. নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে নাসুস্থ বোধ করলেও কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে কোনো সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে৯. একই সঙ্গে এলোপ্যাথিক ও অন্যান্য পদ্ধতির চিকিৎসা চালালে তা ডাক্তারকে জানানো উচিত১০. ওষুধ সবসময় আলো থেকে দূরে, ঠাণ্ডা, শুষ্ক স্থানে, শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুনকিছু কিছু ওষুধ ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হয়নির্ধারিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করলে এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়, এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন১১. ব্যবহারের সময় ওষুধ ভালো আছে কিনা দেখে নিননাম ও মাত্রাটা আবার খেয়াল করুন১২. অনেক সময় দোকানদারগণ প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ না দিয়ে শুধু বিক্রি করার জন্য অন্য কোম্পানির অন্য ওষুধ দিয়ে বলে থাকেন_ একই ওষুধএক্ষেত্রে রোগীদের সতর্ক থাকা উচিত এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে উলি্লখিত নামের ওষুধ কেনা উচিত ওষুধ কেনার সময় আবার ভালো করে যাচাই করে নেবেন এবং ওষুধ বিক্রেতা লিখিত ওষুধের পরিবর্তে অন্য ওষুধ দিচ্ছে কিনা দেখে নিন১৩. বাচ্চা ও বয়স্কদের বেলায় আরও বেশি সতর্ক হতে হবেতাদের বেলায় ওষুধের মাত্রা, চোখের ড্রপ বা মলম এবং ইঞ্জেকশনের প্রয়োগবিধির (যেমন মাংসে বা শিরায়) ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবেএছাড়া চিকিৎসকেরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে তাদের কর্তব্য_

১. রোগীকে রোগ এবং ওষুধ সম্পর্কে জানান২. ওষুধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানান৩. নিজে থেকে বন্ধ করলে কি ক্ষতি হতে পারে জানানকোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে দ্রুত ডাক্তারকে জানানোর পরামর্শ দিন৪. কখন ও কিভাবে ওষুধ বন্ধ করা যাবে জানান৫. নিয়মিত ও নিয়ম মতো ওষুধ খেতে উৎসাহিত করুন৬. রোগীর খরচের দিকটা মাথায় রাখুন অযথা অতিরিক্ত দামী ওষুধ নেহায়েত প্রয়োজন না হলে বা জীবন রক্ষাকারী না হলে না লেখাই ভালো৭. প্রেসক্রিপশনে অসুখের পূর্ণ নাম, ওষুধের নাম, মাত্রা, খাবার নিয়ম, কতদিন খেতে হবে ইত্যাদি স্পষ্টাক্ষরে সুন্দরভাবে লেখা উচিত

এর সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ বিক্রেতার কর্তব্য প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করা, শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে যেনতেনভাবে যে কোনো ওষুধ বিক্রি না করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা, দোকানে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা ও সার্বিক তত্ত্বাবধান করা

ওষুধের অপব্যবহার, বিশেষ করে এন্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স থেকে নিজেদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র:  ইন্টারনেট


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন